বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)
আমরা মুসলিমরা অনেকেই নিয়মিত নামাজ আদায় করে থাকি, কিন্তু নামাজের পরে অল্প কিছু সময় যদি নিয়মিত কিছু আমলের অভ্যাস গড়ে তুলি তবে আমদের আখেরাতে যে পাথেয় তা সমৃদ্ধ করতে পারি। এমনই কিছু আমলের কথা এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ্ এই পোস্টে।
বিসমিল্লাহ–এর ফজিলত
১। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে লক্ষ্য করে এরশাদ করেন, হে আবু হুরায়রা! তুমি যখন অজু করবে, তখন বিসমিল্লাহ বলবে। তাহলে ফেরেশতাগণ তোমার অজু শেষ না হওয়া পর্য ন্ত তোমার জন্য পূণ্য লিখতে থাকবে। তুমি যখন স্ত্রী সহবাস করবে, তখন বিসমিল্লাহ বলবে। তাহলেবে যতক্ষণ না তুমি গোসল শেষ করবে, ততক্ষণ ফেরেশতাগণ তোমার জন্য পূণ্য লিখতে থাকবে। সেই সহবাসে যদি তোমার কোন সন্তান লাভ হয়, তবে সেই সন্তানের নিঃশ্বাস এবং তার যদি বংশধারা চালু থাকে, তবে যতকাল তা চালু থাকবে, ততকাল পর্য ন্ত তাদের সবার নিশ্বাসের সংখ্যা পরিমাণ পূণ্য তোমার আমলনামায় লেখা হতে থাকবে। হে আবু হুরায়রা! তুমি যখন পশুর পিঠে চড়বে, তখন বিসমিল্লাহ বলবে। তাহলে তার প্রতি কদমে তোমার জন্য পূণ্য লেখা হবে। আর যখন নৌকায় চড়বে, তখনো বিসমিল্লাহ বলবে। তাহলে যতক্ষণ না তুমি তা থেকে নামবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার জন্য পূণ্য লেখা হতে থাকবে।
২। রোম সম্রাট একবার খলিফাতুল মুসলিমিন হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু
আনহুর দরবারে তার মাথা ব্যথার কথা জানিয়ে প্রতিকারের জন্য আবেদন করেছিল। হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু
আনহু তাকে একটি টুপি প্রেরণ করেছিলেন। যতক্ষণ এ টুপি মাথায় থাকতো ততক্ষণ মাথা ব্যথা
হতো না। কিন্তু যখনই মাথা থেকে টুপি সরানো হতো, সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা শুরু হতো। এ ঘটনায়
সবাই বিস্মিত হয়। অবশেষে টুপি খুলে এর কারণ অনুসন্ধান করে দেখা গেল যে তাতে শুধু ‘বিসমিল্লাহ’
লিপিবদ্ধ রয়েছে।
৩। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি `বিসমিল্লাহ` লেখা
আছে এমন কোনো কাগজের টুকরা আল্লাহ তায়ালার তাজিমের উদ্দেশ্যে হেফাজত করেন, আল্লাহর
কাছে তার নাম সিদ্দিকদের তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয় এবং তার পিতামাতার শাস্তি লাঘব করা
হয়, যদিও তারা মুশরিক হয়ে থাকে।’
আয়াতুল কুরসিঃ
উচ্চারণঃ
আল্লাহু লা ইলাহা ইল্লা হুয়াল হাইয়্যুল ক্কাইয়্যুম।লা
তা’খুজুহু সিনাত্যু ওয়ালা নাউম। লাহু মা ফিসসামা ওয়াতি ওয়ামা ফিল আরদ্। মান যাল্লাযী
ইয়াস ফায়ু ইনদাহু ইল্লা বি ইজনিহি, ইয়া লামু মা বাইনা আইদিহিম ওয়ামা খালফাহুম,
ওয়ালা ইউ হিতুনা বিশাই ইম্ মিন ইল্ মিহি ইল্লা বিমা শা'আ,ওয়াসিয়া কুরসি ইউহুস সামা
ওয়াতি ওয়াল আরদ, ওয়ালা ইয়া উদুহু হিফজুহুমা ওয়াহুয়াল আলিয়্যূল আজীম।
বাংলা অনুবাদঃ
আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, তিনি জীবিত, সবকিছুর ধারক। তাকে তন্দ্রাও স্পর্শ করতে পারে না এবং নিদ্রাও নয়। আসমান ও যমীনে যা কিছু রয়েছে, সবই তার। কে আছ এমন, যে সুপারিশ করবে তার কাছে তার অনুমতি ছাড়া? দৃষ্টির সামনে কিংবা পিছনে যা কিছু রয়েছে সে সবই তিনি জানেন। তার জ্ঞানসীমা থেকে তারা কোনো কিছুকেই পরিবেষ্টিত করতে পারে না, কিন্তু যতটুকু তিনি ইচ্ছা করেন। তার কুরসি (সিংহাসন) সমস্ত আসমান ও যমীনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তার পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান।[১]
আয়াতুল কুরসির ফজিলতঃ
আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন: যে ব্যক্তি প্রতি ফরজ নামায শেষে আয়াতুল কুরসী পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশ করতে মৃত্যু ছাড়া কোন কিছু বাধা হবে না। [সহীহ আল্ জামে :৬৪৬৪]
হজরত আলী (রা:) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে বলতে শুনেছি- যে ব্যক্তি প্রত্যেক
ফরজ সালাতের পর আয়াতুল কুরসি নিয়মিত পড়ে, তার জান্নাতে প্রবেশে কেবল মৃত্যুই অন্তরায়
হয়ে আছে। যে ব্যক্তি এ আয়াতটি বিছানায় শয়নের সময় পড়বে আল্লাহ তার ঘরে, প্রতিবেশীর
ঘরে এবং আশপাশের সব ঘরে শান্তি বজায় রাখবেন। [সুনানে বাইহাকী]
শয়নকালে পাঠ করলে সকাল পর্যন্ত তার হেফাজতের জন্য একজন ফেরেশতা পাহারায় নিযুক্ত
থাকে। যাতে শয়তান তার নিকটবর্তী হতে না পারে। (বুখারি) হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত:
রাসুল (সা.) বলেছেন: সুরা বাকারায় একটি শ্রেষ্ঠ আয়াত রয়েছে, যে ঘরে আয়াতুল কুরসী
পাঠ করা হবে সেখান থেকে শয়তান পালাতে থাকে। [মুস্তাদরাকে হাকিম:২১০৩]
আবূ হুরাইরাহ (রাযিয়াল্লা-হু ‘আনহু) বলেছেন, রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন,
সূরা আল বাক্বারায় এমন একটি আয়াত রয়েছে যা কুরআনের অন্য সব আয়াতের সর্দার বা নেতা।
সে আয়াতটি যে ঘরে পড়া হয়, তা থেকে শয়তান বেরিয়ে যায়। [তাফসীর মা’ আরেফুল কুরআন-১ম খণ্ড,
পৃ: ৬৭৬]
সুরা ইখলাসঃ
বিস্মিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম
উচ্চারণঃ
কু’ল হু ওয়া ল্লা-হু আহাদ ৷
আল্লা-হু স্সামাদ ৷
* লাম ইয়ালিদ ওয়া লাম ইয়ুলাদ ৷
*ওয়া লাম ইয়াকু ল-লাহু কুফুওয়ান আহাদ!
অনুবাদঃ
বল, তিনিই আল্লাহ্ এক!
** আল্লাহ অমুখাপেক্ষী ।
** তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং কেউ তাকে জন্ম দেয়নি।
** তার সমতুল্য আর কেউ নেই!
সুরা ইখলাসের ফজিলতঃ
১। কোরআন শরীফ এর এক তৃতীয়াংশের সমান
আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, জনৈক ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে রাতে বারবার সুরা আল-ইখলাস পড়তে শুনেছেন। অতঃপর সকালে মহানবী (সা.)-কে এ বিষয়টি অবহিত করা হলো। মহানবী (সা.) তখন বলেন, ওই সত্তার শপথ, যার কুদরতের হাতে আমার জীবন, অবশ্যই এ সুরা কোরআন মাজিদের এক-তৃতীয়াংশের সমান। (সহিহ বুখারি : ৫০১৩, আবু দাউদ : ১৪৬১, নাসায়ি : ২/১৭১, মুআত্তা মালেক : ১/২০৮)
মহানবী (সা.) একদা সাহাবিদের বলেন, তোমারা কি এক রাতে
কোরআন মাজিদের এক-তৃতীয়াংশ পড়তে পারবে? সাহাবিরা এ প্রস্তাবকে খুবই কঠিন মনে করলেন।
ফলে তারা বলল, আমাদের মধ্যে এ কাজ কে করতে পারবে? মহানবী (সা.) তখন বললেন, সুরা ইখলাস
কোরআনের এক-তৃতীয়াংশের সমান। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫০১৫, নাসায়ি, হাদিস :
৯৯৫)
কোরআন মাজিদ তিন ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ আহকাম বা বিধি-বিধানসংক্রান্ত।
আরেক ভাগ জান্নাতের সুসংবাদ ও জাহান্নামের দুঃসংবাদসংক্রান্ত এবং অন্য ভাগ আল্লাহর
নাম ও গুণাবলিসংক্রান্ত। শেষোক্ত ভাগটি সুরা ইখলাসে একত্রিত হওয়ার কারণে একে কোরআন
মাজিদের এক-তৃতীয়াংশ বলা হয়েছে। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে মহানবী
(সা.) বলেছেন, আল্লাহ কোরআনকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। আর এ সুরাটি (সুরা ইখলাস)-কে একটি
ভাগে পরিণত করেছেন। (মুসলিম, হাদিস : ৮১২, তিরমিজি, হাদিস : ২৯০০)
২। সুরা ইখলাসকে ভালোবাসলে আল্লাহও ভালোবাসেন
মহানবী (সা.) একজন সাহাবির নেতৃত্বে একদল সৈনিককে যুদ্ধে
প্রেরণ করেন। তিনি যুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে শুধু সুরা ইখলাস দ্বারা নামাজ পড়িয়েছেন। সৈন্যরা
যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে মহানবী (সা.)-কে তা অবহিত করেন। মহানবী (সা.) তাদের বলেন, তোমরা
তাকে জিজ্ঞেস করো কেন সে এরূপ করেছে। সেনাপতি বললেন, এ সুরায় আল্লাহর গুণাবলি বর্ণিত
হয়েছে বিধায় আমি এ সুরাকে ভালোবাসি। মহানবী (সা.) সাহাবিদের বলেন, তোমরা তাকে
গিয়ে বলো, আল্লাহও তাকে ভালোবাসেন। (সহিহ বুখারি হাদিস নং ৭৩৭৫, মুসলিম হাদিস নং ৮১৩,
নাসায়ি ২/১৭০)
৩। জান্নাত লাভ : জনৈক সাহাবি মহানবী (সা.)-এর কাছে
এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল (সা.)! আমি সুরা ইখলাসকে ভালোবাসি। রাসুলুল্লাহ (সা.) তখন
বলেন, এ ভালোবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৭৪, তিরমিজি,
হাদিস : ২৯০১)
৪। গুনাহ মাফ : মহানবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি প্রতিদিন
২০০ বার সুরা ইখলাস পড়বে, তার ৫০ বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে, তবে ঋণ থাকলে
তা মাফ হবে না। (তিরমিজি, হাদিস : ২৮৯৮)
৫। দারিদ্র্য দূর : সাহল ইবন সাদ সায়েদি (রা.) থেকে
বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-এর কাছে দারিদ্র্যের অভিযোগ করল, মহানবী
(সা.) তাকে বললেন, যখন তুমি ঘরে যাও তখন সালাম দেবে এবং একবার সুরা ইখলাস পড়বে। এ
আমল করার ফলে কিছু দিনের মধ্যে তার দারিদ্র্য দূরীভূত হয়ে যায়। (কুরতুবি : ২০/১৮৫)
৬। আবু দাউদ, তিরমিযী ও নাসায়ীর এক দীর্ঘ রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ
বলেনঃ যে ব্যক্তি সকাল-বিকাল সূরা ইখলাস, ফালাক্ব ও নাস পাঠ করে তা তাকে বালা-মসীবত
থেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে যথেষ্ট হয়। - (ইবনে-কাসীর)
৭। ওকবা ইবনে আমের -এর রেওয়ায়েতে রসুলুল্লাহ বলেনঃ আমি তোমাদেরকে এমন তিনটি সূরা বলছি, যা তওরাত, ইঞ্জীল, যবুর ও কোরআনসহ সব কিতাবেই রয়েছে। রাত্রিতে তোমরা ততক্ষণ নিদ্রা যেও না, যতক্ষণ সূরা এখলাস, ফালাক ও নাস না পাঠ কর। ওকবা বলেনঃ সেদিন থেকে আমি কখনও এই আমল ছাড়িনি। - (ইবনে কাসীর)